জোটের প্রার্থী হলেও ভোট করতে হবে নিজ প্রতীকে
নির্বাচনি জোট হলেও প্রার্থীদের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করতে হবে নিজ দলের প্রতীকে। এ ছাড়া মামলায় পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এমন বিধান যুক্ত করে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
অনুমোদিত খসড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিন বাহিনীকে নির্বাচনি দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। আর সংসদীয় আসনে একজন প্রার্থী থাকবেন সেখানে ভোটারেরা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন এবং কোনো সংসদীয় আসনে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ঢাকার তেজগাঁওয়ে তার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সংশোধিত আরপিওর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, যদি নির্বাচনি জোট হয়, তা হলে জোটের অংশ হলেও দলের যে প্রতীক, সেটি দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সংজ্ঞা, সেখানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সম্পর্কিত যেসব বিধান ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় পলাতক ব্যক্তিরা নির্বাচন করতে পারবেন না, এটিও যুক্ত করা হয়েছে।
পলাতক আসামি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে- সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘পলাতক হচ্ছে- আদালত যখন পলাতক ঘোষণা করেন। যেদিন আদালত আপনাকে আসতে বলছেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, আসছেন না- আদালত পলাতক ঘোষণা করেন। বিচার চলাকালে পলাতক হয়।’
এর আগে এ মাসেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। সেই সংশোধনী অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় কারও বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) অনেক নেতার বিচার চলছে। এ ছাড়া অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলটির বহু নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন, যাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা রয়েছেন। তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই নেতারা আদালত থেকে পলাতক ঘোষিত হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাবেন না।
প্রার্থীর জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা : আইন উপদেষ্টা বলেন, যারা নির্বাচন করবেন, তাদের এফিডেভিটের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে যত আয় ও সম্পত্তি আছে, তার সবকিছুর বিবরণ দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা এই নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। জেলা নির্বাচনি কার্যালয় জেলার নির্বাচনি কর্মকর্তা ঠিক করবেন।
‘না’ ভোট দেওয়া যাবে, পুরো আসনের ভোট বাতিল করতে পারবে ইসি : সংশোধিত আরপিওতে ‘না’ ভোটের বিধান রাখার কথা জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, যে সংসদীয় আসনে একজন প্রার্থী থাকবেন, সেখানে ভোটাররা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। ২০১৪ সালের ভুয়া, সাজানো নির্বাচন যেন না হয়- সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন যে প্রার্থী পছন্দ না, সেখানে না ভোট দিতে পারবে। আর কোনো সংসদীয় আসনে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগের আইনে বিধান ছিল- কোনো ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল হলে কেন্দ্রের ফলাফল বাতিলের। এখন ইসি যদি মনে করে একটা নির্বাচনি এলাকাতেই এত অনিয়ম হয়েছে, পুরো এলাকার ভোট বাতিল করা উচিত; তা হলে সেটা করতে পারবে। সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর আইন নীতিগত অনুমোদন : উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অধ্যাদেশ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-২০২৫ (আরপিও বা রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডার অর্ডিন্যান্স) আইন পাসের চূড়ান্ত অনুমোদনের পাশাপাশি আরও তিনটি আইনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। আইন তিনটি হলো- সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর আইন। এ তিনটি আইন সম্পর্কে আরও কিছুটা আলোচনা শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করা হবে।
পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন প্রবাসীরা : আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিধান আরপিও যুক্ত করা হয়েছে। এবার আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং চালু করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অনলাইনে নিবন্ধন সেরে ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। পাশাপাশি কারা হেফাজতে থাকা, সরকারি কর্মকর্তা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা এভাবে ভোট দিতে পারবেন। ভোট গণনার সময় সাংবাদিকদের উপস্থিত থাকার বিধানটিও যুক্ত করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনে বডিক্যাম এবং সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের আলোচনা হচ্ছে। এটা আইনগতভাবে কতটুকু করা যায়, যিনি ব্যবহার করবেন তিনি কীভাবে কোথায় ব্যবহার করবেন সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদে। ড্রোন ব্যবহারসহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বরত পুলিশকে বডিক্যাম প্রদান, নির্বাচনি কেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ড্রোন ওড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ বিষয়ে আইনগত দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।












